ইসলামে মাতা-পিতার অধিকার
অতঃপর আমি ঘুরতে লাগলাম, শেষ পর্যন্ত দেখা পেলাম এক যুবকের, যার ঘাড়ে একটি ঝুড়ির মধ্যে রয়েছে এক বৃদ্ধলোক, মনে হচ্ছিল যেন একটি মুরগীর বাচ্চা; তারপর সে সব সময় তাকে তার সামনে রাখত এবং তাকে খাওয়াতো যেমনিভাবে মুরগীর বাচ্চাকে খাওয়ানো হয়; তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম: ওনি কে? সে বলল: আমার আব্বা, বয়সের ভারে তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আমি তাকে দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়েছি; তখন আমি বললাম: এই হল আরবের সবচেয়ে অনুগত ও ভাল মানুষ।
{ইবরাহীম আল-বায়হাকী, ‘আল-মাহাসেন ওয়াল মাসাওয়ী’ (المحاسن و المساوئ ), পৃ. ৬১৪}
.
আমরা সাধারণত সকল ইবাদত করলেও একটি ইবাদত এর ক্ষেত্রে সবাই উদসীন তা হলো মাতা-পিতার সাথে সৎ ব্যবহার। এটি একটি ওয়াজিব বিধান। কিন্তু আমরা প্রায় সকলেই কম-বেশি খারাপ আচরন করে থাকি পিতা-মাতার সাথে যার পরিনাম ভয়াবহ।
পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার বিষয়টি ইসলামী শরী‘য়তের মহান সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত; এটা হল অনুগ্রহের স্বীকৃতি, মর্যাদা সংরক্ষণ, শরী‘য়তের পরিপূর্ণতার প্রমাণ এবং অন্তর্ভুক্ত করে সকল প্রকার অধিকারকে।
বস্তুবাদী পৃথিবীর মানব রচিত আইনকানুন তার বিপরীত, যা পিতামাতার জন্য কোনো বিশেষ মর্যাদা নির্ধারণ করেনি এবং তাদের জন্য কোনো অধিকার সংরক্ষণ করে নি; বরং তা তাদেরকে অবজ্ঞা করেছে এবং হেয় প্রতিপন্ন করেছে।
আর প্রযুক্তিতে অগ্রগামী পশ্চিমা বিশ্বই হলো এর জ্বলন্ত সাক্ষী; কারণ, ঐ শাসন ব্যবস্থায় বাবা-মা হলেন এমন এক যন্ত্রের মত, যখন তার কার্যকারিতার সময়কাল শেষ হয়ে যায়, তখন তাকে মাটিতে ছুড়ে ফেলা হয়।
আর তাদের চিন্তা-চেতনা থেকে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের অতি সীমিত এক পন্থার উদ্ভব হয়েছে যে, তারা একটি বার্ষিক দিবস চালু করেছে, যার নাম দিয়েছে ‘মা দিবস’, 'বাবা দিবস'। সে দিন ছেলে ও মেয়েরা ভালবাসা ও সদ্ব্যবহারের প্রতীক হিসেবে তাদের মাকে বাবাকে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল উপহার হিসেবে প্রদান করে।
এটাই হলো তাদের পক্ষ থেকে পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার চূড়ান্ত নমুনা; বছরে একদিন, অন্য কোনো দিন নয়! তাহলে সেবা-যত্ন কোথায়? অথবা সহানুভূতি কোথায়? আর দায়িত্ব পালনের বিষয়টি বা কোথায়?
এসব মার্জিত মর্যাদাপূর্ণ অর্থবোধক শব্দের কোনো জ্ঞান তাদের নেই এবং তাদের নিকট এর কোনো অংশের বাস্তবতা নেই।
পিতামাতার দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকা এবং তাদের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করা: আর এটা হল পিতামাতার অবাধ্যতার জঘন্য রূপ; কারণ, কোনো কোনো সন্তানকে দেখা যায়, সে যখন সামাজিকভাবে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন স্থানে উন্নিত হয় অথবা বড় রকমের চাকুরি পেয়ে যায়, তখন সে তার পিতামাতাকে স্বীকার করতে চায় না এবং তাদের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতে চায়; আর সে তার ঘরের মধ্যে পুরাতন পোষাক-পরিচ্ছদে তাদের অবস্থান করাটাকে রীতিমত অপমানবোধ করে।
কোনো কোনো ছেলে-সন্তানকে দেখবেন যে, সে তার পিতামাতার সামনে স্ত্রী’র জন্য মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসা প্রকাশ করে এবং একই সময় তাকে দেখবেন যে, সে তার পিতামাতার প্রতি রূঢ় আচরণ করে, অথচ সে তাদের অধিকারের প্রতি কোনো লক্ষ্য রাখে না
আবার কখনও কখনও তাদের ব্যাপারে তার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, তখন সে বলে দেয়: ওরা আমাদের চাকর-বাকর।
আবার কোনো কোনো সন্তান বিয়ে-সাদী ও সাধারণ অনুষ্ঠানসমূহে লজ্জায় তার পিতার নাম উচ্চারণ করার বিষয়টি এড়িয়ে চলে! আর এই ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট মন-মানসিকতা, দুর্বল বুদ্ধি, মর্যাদাহীনতা ও চরম অধৈর্যের প্রমাণ বহন করে। তবে
পিতামাতাকে ভালোবাসে প্রেমিক ভদ্র মানুষ তার উৎসস্থল, প্রজন্ম ও মূলকে নিয়ে গৌরব বর্ণনা করে; আর ভদ্রজনেরা সুন্দরকে ভুলে যায় না।
” إن الكرام إذا ما أيسروا ذكروا
من كان يألفهم في المنزل الخشن”.
(ভদ্রলোকেরা যখন স্বচ্ছল হয়ে যায়, তখন আলোচনা করে তারা সেই জনদের, জীর্ণ কুঠিরে তাদেরকে আদর-সোহাগ করেছেন যারা)।
ইসলামে মাতাপিতার অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয়েছে এবং এটাই শুধু নয়, বরং ইসলাম পিতামাতার অবাধ্য হতে নিষেধ করেছে এবং তার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে; কারণ, তা কবীরাগুনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম এবং শিরকের সমমানের অপরাধ। এ ব্যাপারে
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ إِمَّا يَبۡلُغَنَّ عِندَكَ ٱلۡكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوۡ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ وَٱخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحۡمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا
[الاسراء: ٢٣، ٢٤] ﴾٢٤﴿ 
“আর তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত না করতে এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; আর তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো। আর মমতাবেশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করো এবং বলো, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর, যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”
আর এ প্রসঙ্গে অনেক হাদিস বর্ণিত আছে; তন্মধ্যে অন্যতম একটি হাদিস, আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনিল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত,
الكبائرُ : الإشراكُ بالله ، وعُقوقُ الوالدين ، وقتْلُ النفس ، واليمينُ الغموسُ
» . ( رواه البخاري)«
“অন্যতম কবীরা গুনাহসমূহ হল: আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা কসম করা।”
(বুখারী)
পিতামাতার জন্য এই মর্যাদা, বিশেষ করে তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার ব্যাপারে জোরালো নির্দেশ এবং তাদের অবাধ্য হতে নিষেধ করে কঠোর ধমক আসা সত্ত্বেও একদল মানুষ তাদেরকে দেওয়া উপদেশের একটা বিরাট অংশকে ভুলে গেছে; ফলে তারা পিতামাতার অধিকারকে সংরক্ষণ করে না এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার বিষয়টিকে পরোয়া করে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের পিতা-মাতার অবাধ্যতা থেকে হেফাজত করুন। দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণে পিতা-মাতার খেদমতে নিয়োজিত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Ameen
ReplyDelete